
শেখ মামুনুর রশীদ মামুন:- ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচার পতনের যে ‘স্পিরিট’ জন্ম নিয়েছিল, সেই চেতনা ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের মন-মগজে স্পর্শও করেনি। বরং সেই চেতনার অপমান করে এখানে চলছে লাগামহীন ঘুষ বাণিজ্য—‘চ্যানেল ফাইল’ নামের এক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ছত্রছায়ায়। ৫ আগস্টের পর এক মাস বন্ধ থাকলেও, সকল মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে পাসপোর্ট অফিসে ফের চালু হয়েছে ‘চ্যানেল ফাইল’। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি আবেদন ফাইলে এখন খরচ দেখিয়ে নেয়া হয় এক হাজার টাকা করে। প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ আবেদন জমা হওয়ায় দৈনিক ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক লাখ টাকা! ঘুষের কারিগর কারা? সরাসরি জড়িত ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. জামাল উদ্দীন। দালাল সিন্ডিকেট, অফিস স্টাফ ও আনসার সদস্যদের সাথে গোপন আঁতাতে চলছে এই মহাঘটনা। জানা গেছে, প্রতিটি ‘চ্যানেল ফাইল’ দালালদের মাধ্যমে চিহ্নিত সংকেতে জমা হয়, যাতে সহজে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় ফাইল। যদি সংকেত না থাকে, তবে ‘ত্রুটিপূর্ণ আবেদন’ দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হয়। এই সংকেতেই বুঝে নেওয়া হয়—ঘুষ এসেছে কি না। অফিসের ভেতরে রমরমা দালাল রাজত্বঃ কম্পিউটার দোকানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসের প্রতিটি স্তরে এই সিন্ডিকেটের প্রভাব। এমনকি অফিস কক্ষেও তাদের অবাধ বিচরণ! অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি দালালের আলাদা ‘কোড’ রয়েছে, যার ভিত্তিতে ডিডি-এডি বুঝে নেন কার মাধ্যমে ঘুষ এসেছে। সপ্তাহ শেষে প্রতিবার ভাগ হয় ঘুষের টাকা। উপ-পরিচালক ওয়ালিউল্লাহ পান এর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। বাকি টাকা দালাল, পিয়ন, আনসার এবং অফিস কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন হয়। পাসপোর্ট অফিসে ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ হয় কি না’—জানতে চাইলে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন উপ-সহকারী পরিচালক মো. জামাল উদ্দীন:>“জুলাই স্পিরিট, ৫ আগস্ট কিছু বুঝিনা। আমরা আমাদের কাজ করছি। চ্যানেল ফাইল তো ওপেন সিক্রেট—সবাই জানে।” একজন প্রবীণ শিক্ষকের মন্তব্য, “যে কর্মকর্তা ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ও দুর্নীতিবিরোধী স্পিরিট বুঝেন না, তার ঐ পদে বসার নৈতিক অধিকার নেই।” পাসপোর্ট আবেদনকারীদের চরম দুর্ভোগ, নির্ধারিত সময় পার হলেও পাসপোর্ট না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল হলেও সেই নামে টাকা আদায় চলছে। এছাড়া অনলাইন ফি ও কাগজপত্র প্রস্তুতের নামে আরও হাজার টাকার বাণিজ্য। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা সাধারণ মানুষ। পাল্টা দাবি উপ-পরিচালকের-সব অভিযোগ অস্বীকার করে ডিডি শাহ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেন,>“সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে দিন, আমি দেখব। দালাল দৌরাত্ম্য রুখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।” কিন্তু ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল বলছেন, “অভিযোগ তো অনেক। কিন্তু তদন্ত কে করবে?” দাবি—দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। স্থানীয় সচেতন মহল ও সুশীল সমাজের নেতারা বলছেন,>“এটি শুধু ঘুষ নয়—জাতির আত্মমর্যাদাকে অপমান। যারা জনগণের ওপর ট্যাক্স নিয়ে সরকারি বেতন নেন, তারাই ঘুষ নিয়ে পাসপোর্ট বানিজ্যে জড়িত—এটা বরদাস্ত করা যায় না।” তাদের একমাত্র দাবি: দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত, অভিযুক্তদের অপসারণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান কোনো ইতিহাস নয়—এটি ছিল জাতির প্রত্যয়ের জাগরণ। সেই চেতনাকে ধুলোয় মিশিয়ে যদি আজ পাসপোর্ট অফিস হয় ঘুষের আখড়া, তবে তা শুধুই লজ্জাজনক নয়—এটি জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত স্বাধীনতার অপমান।



Discussion about this post