
বিশেষ প্রতিনিধি: ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার বালিখা ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ভয়াবহ বিস্তারকে ঘিরে জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি সুপরিকল্পিত ও ক্ষমতাসম্পন্ন সিন্ডিকেট অবৈধভাবে নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন পরিচালনা করছে ভূয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে—যার মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে একদল স্বঘোষিত ভূয়া কাজী। এদের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল, যারা নিয়মিতভাবে আইন ভঙ্গ করে যাচ্ছে প্রশাসনের আশ্চর্যজনক নীরবতার সুযোগে। ভূয়া কাজী সিন্ডিকেট: সরকারি গেজেটভুক্ত রেজিস্ট্রিকৃত কাজী মোঃ রাশিদুজ্জামান চকদার লিখিত অভিযোগে বলেন, তিনি ২০২০ সালে আইন মন্ত্রণালয়ের আদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বৈধ কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি দেখতে পান, ইউনিয়নে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ভূয়া বালাম বহি ব্যবহার করে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন পরিচালনা করছেন, যার মাধ্যমে আইন অমান্য করেই একের পর এক বাল্যবিবাহ ঘটিয়ে চলেছেন। লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী, অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন যুবলীগ নেতা ফয়সাল আহমেদ ছফির (সাধারণ সম্পাদক, ইউনিয়ন যুবলীগ), আবুল মুনসুর, মোজাম্মেল হক সরকার, ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক আরিফ রব্বানী ও এমদাদুল হক—যারা নিজেদের কাজী পরিচয়ে ভূয়া নিকাহ রেজিস্ট্রেশন করে যাচ্ছেন। হুমকি ও ভয়ভীতি:কাজী রাশিদুজ্জামান লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন, এই অপকর্মে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করায় তিনি একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি ও গালিগালাজের শিকার হয়েছেন। এমনকি তাকে বলা হয়েছে, “আর একবার থানায় গেলে লাশ গুম করে ফেলা হবে বা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হবে।”প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা: বহুবার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসাইন এবং ওসি মোহাম্মদ টিপু সুলতান কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সরেজমিনে সাংবাদিকরা অপরাধীদের চিহ্নিত করেও প্রশাসনের নীরবতা ভঙ্গ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা প্রকাশ্যে বলছেন, “সব ইউএনওকে ম্যানেজ করেই হচ্ছে! আইনি বিশ্লেষণ: আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,দণ্ডবিধি ৪৬৮ ধারা অনুযায়ী, জাল দলিল ও রেজিস্ট্রেশন পরিচালনা করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুসারে, কেউ যদি বাল্যবিবাহে সহায়তা করে, তাহলে সর্বোচ্চ ২ বছর জেল ও অর্থদণ্ড হতে পারে। দণ্ডবিধি ৫০৬ ধারা অনুযায়ী, সরকারি দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে হুমকি দেওয়া হলে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনিক ব্যর্থতা নাকি সহায়তা? জনমনে প্রশ্ন—যখন বৈধ কাজী, স্থানীয় সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিরা বারবার লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ দিচ্ছেন, তাহলে প্রশাসন কেন নিশ্চুপ? বিষয়টি কি শুধুমাত্র অবহেলা, নাকি প্রশাসনের কিছু অংশ সিন্ডিকেটের সঙ্গে অপ্রকাশ্য সমঝোতায় জড়িত? প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়,ইউএনও বলেন: “থানায় অভিযোগ দেন, আমি ওসিকে বলে দেবো।”ওসি বলেন: “ইউএনও অফিসে অভিযোগ দেন। অথচ দুইজনের কাছেই পূর্বে একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে, যার কোনো অনুসন্ধান বা মামলা হয়নি! জনতার দাবি: স্থানীয় সচেতন নাগরিক, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিক সমাজ একযোগে দাবি জানিয়েছেন—১. ইউএনও জাকির হোসাইন ও ওসি মোহাম্মদ টিপু সুলতানকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। ২. নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. ভূয়া কাজীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করতে হবে এবং রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির সব তথ্য সংগ্রহ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যায়ে প্রশাসনিক উদাসীনতা ও দুর্নীতি কিভাবে আইনের শাসনকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারাকান্দার এই ঘটনা। এখন প্রয়োজন দ্রুত এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের—না হলে এমন সিন্ডিকেট দেশজুড়ে দুর্বল আইনপ্রয়োগের সুযোগ নিয়ে সমাজকে আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।



Discussion about this post