
মোঃ ফজলুল কবির গামা, বিশেষ প্রতিনিধি শৈলকুপা (ঝিনাইদহ): পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে যখন বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীরা নতুন করে জীবনের খোঁজে লোকালয়ের কাছাকাছি আসছে, তখন তাদের আশ্রয়স্থল পরিণত হচ্ছে বধ্যভূমিতে। গত কয়েক মাসে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একের পর এক ঘটে চলেছে এমন অমানবিক ঘটনা। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে পরিযায়ী এসব প্রাণীরা যখন বিপন্ন হয়ে লোকালয়ে আশ্রয় চাইছে, তখন স্থানীয়দের হিংস্র আক্রমণে মারা যাচ্ছে তারা। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মীদের নীরব ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
বন্যপ্রাণী হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতা
গত জুনে শৈলকুপার হাকিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে খাবারের খোঁজে একটি বিলুপ্তপ্রায় কুমির রাতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। স্থানীয়দের কাছে সে আশ্রয় না পেয়ে শিকার হয় নির্মমতার। উত্তেজিত জনতা কুমিরটিকে পিটিয়ে হত্যা করে এবং উল্লাস করতে থাকে। এই ঘটনার এক মাস না পেরোতেই গড়াই নদীতে জেলেদের জালে আটকে পড়ে একটি শুশুক। আহত এই প্রাণীটিকে চিকিৎসার পরিবর্তে মেরে ফেলা হয়।
সর্বশেষ, শৈলকুপা পৌরসভার সাতগাছিতে ঘটে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। একটি মেছোবাঘ ধানের ক্ষেতে আশ্রয় নিলে ধান কাটা মেশিনে গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় স্থানীয় জনগণ তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এভাবে একের পর এক বিরল প্রজাতির প্রাণী হত্যার ঘটনা স্থানীয় পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এবং শাস্তির বিধান
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কার্যকর রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, যেকোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, বা তাদের বাসস্থান ধ্বংস করা একটি গুরুতর অপরাধ। এই আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী, কুমির, শুশুক এবং মেছোবাঘ হলো সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী। এদের হত্যা করলে বা ক্ষতিসাধন করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
এই আইনের ধারা ৩৮ (১) অনুযায়ী, সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী হত্যা বা শিকার করলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তির মাত্রা আরও বাড়ে, যা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় হতে পারে।
এই আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা প্রকাশ্যে এমন বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না, যা আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, বরং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
সচেতনতার অভাব এবং আইন প্রয়োগের শিথিলতা
যখন একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে, তখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাণীদের সুরক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। ফলে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে সমস্ত প্রাণী অপরিহার্য, তারা আজ মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারীরা বলছেন, এই ধরনের নিষ্ঠুরতা বন্যপ্রাণীর প্রতি মানুষের অজ্ঞতা এবং তাদের প্রতি ভালোবাসার অভাব থেকেই আসে। জনসচেতনতার অভাব ও আইনি পদক্ষেপের শিথিলতার কারণে অপরাধীরা শাস্তি পায় না, ফলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে।
এই নিষ্ঠুরতা অব্যাহত থাকলে শৈলকুপার পরিবেশ থেকে একসময় বিরল প্রজাতির প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে, অবিলম্বে এসব অমানবিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে এবং বন্যপ্রাণী রক্ষায় কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিও এখন সময়ের দাবি।



Discussion about this post