
নিজস্ব প্রতিনিধি:- আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনের পর গাজীপুরের পূবাইল এলাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতার পালাবদলের পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে চলে যান। তাদের অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ৬ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিদিনই পূবাইলসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় তারা শোডাউনের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। স্থানীয় ত্রিকাগুলোতে এ বিষয়ে একাধিক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে, বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে শিল্পকারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অবৈধভাবে জমি দখল, ব্যবসা দখল এবং নিয়মিত চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন গাজীপুর মহানগরের পূবাইল থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন মোল্লা। রাকিব হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে দলের অভ্যন্তরেই ক্ষোভ খোদ বিএনপির অভ্যন্তরেই রাকিব হোসেন মোল্লার কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন এবং স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দমন করছেন। এসব কারণে তার বিরুদ্ধে নিজ দলেরই কয়েকজন নেতা লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছেন গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। অভিযোগগুলো পৌঁছে গেছে দলের হাইকমান্ড পর্যন্ত। তবে, এখন পর্যন্ত দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গাজীপুর আদালতে তার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছেন। দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বারবার অভিযোগ উঠলেও রহস্যজনক কারণে দলীয় পর্যায়ে কোনো তদন্ত কিংবা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এতে করে প্রশ্ন উঠেছে, দল কি চাঁদাবাজি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? এ অবস্থায় স্থানীয় সাধারণ মানুষসহ দলীয় কর্মীরাও চাইছেন, রাকিব হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে দ্রুত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। গাজীপুরের পূবাইল থানাধীন তালটিয়া পূর্বপাড়া এলাকায় মসজিদ কমিটি গঠন নিয়ে শুরু হওয়া বিরোধের জেরে পরপর দুটি সহিংস ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে তালটিয়া পূর্বপাড়া সুন্নি বাইতুল নূর জামে মসজিদে কমিটি পরিবর্তন নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই দিন মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেম পরিবর্তন নিয়ে কথাবার্তার সময় পূবাইল থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন মোল্লা এ বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইঙ্গিত দেন। তখন স্থানীয় বাসিন্দা মোক্তার হোসেন বলেন, “মসজিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মসজিদ কমিটি।” এ কথার পরপরই রাকিব হোসেন মোল্লা মুসুল্লীদের সামনে মোক্তার হোসেনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। প্রতিবাদ করায় রাকিবের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল মোক্তার হোসেনের ওপর হামলা চালিয়ে বেধড়ক মারধর করে তাকে গুরুতর জখম করে। এসময় আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন। এরপর, দ্বিতীয় একটি হামলার ঘটনা ঘটে ২৫ আগস্ট ২০২৫ রাত ১০টার দিকে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মোক্তার হোসেনকে নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের শেষে বাসায় ফেরার পথে শহিদা খাতুন ডিজিটাল হাসপাতালের সামনে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা রাকিব হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে রাসেল, কাকন, ছালাম, সেলিম, বাহারুল, সৌরভ, রিপনসহ ১০-১২ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূবাইল থানা বিএনপির অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোয়াইবুল ইসলাম সোহাগের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় চাপাতির কোপে সোহাগ গুরুতর জখম হন এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তার সাথে থাকা একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। সোহাগের আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সোয়াইবুল ইসলাম সোহাগকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি পূবাইল থানায় রাকিব হোসেন মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে মারধর ও টাকা লুট: রাকিব মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা গাজীপুর মহানগরের পূবাইল থানার সোরল গ্রামের ব্যবসায়ী সরাফত সরকারের উপর চাঁদা না দেওয়ায় হামলার অভিযোগ উঠেছে। গত ১ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে সরোল মন্দিরের সামনে সরাফতের উপর হামলা চালিয়ে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় চাঁদাবাজ চক্র। এ ঘটনায় গাজীপুর বিজ্ঞ অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা (নং-২৬৬/২৫) দায়ের করা হয়। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন। সরাফত সরকার এবং তার ভাই সাখাওয়াত সরকার দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে এগ্রোফার্ম ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। সম্প্রতি ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মাটি ভরাট কাজ শুরু করলে এলাকার একটি সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র তাদের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। সরাফত সরকার এ দাবি অস্বীকার করলে গত ১ অক্টোবর রাতে তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হামলার শিকার হতে হয়। অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি-সমর্থিত স্থানীয় চাঁদাবাজ চক্রের সদস্য মোঃ রাকিব হোসেন মোল্লা, মোঃ জাকির সরকার, রানা চন্দ্র ও আরও ১০-১২ জন সরাফতের পথরোধ করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং তার সঙ্গে থাকা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, মোঃ রাকিব হোসেন মোল্লা পূবাইল থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মোঃ জাকির হোসেন সরকার পূবাইল থানা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপি নেতার মামলা উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর, পূবাইল থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোয়াইবুল ইসলাম সোহাগ (৪০) আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, রাকিব হোসেন মোল্লাসহ ৮ জন তাকে মারধর করেছে।
এ ঘটনায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩ নম্বর আদালতে সিআর মামলা (নং-২৫০/২৫) দায়ের করা হয়, যার তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে সোয়াইবুল ইসলাম সোহাগ মারধরের পাশাপাশি আরও নানা অভিযোগ করেছেন রাকিব মোল্লা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ রাকিব মোল্লার বিরুদ্ধে আরও একাধিক অভিযোগ তুলে ধরেন সোয়াইবুল ইসলাম সোহাগ। গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি ২৮/১ নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। ওই লিখিত অভিযোগে রাকিব মোল্লার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল ব্যবসা, ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও সতর্কবার্তা পূবাইল থানা বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দলের হাইকমান্ড থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও রাকিব মোল্লা তা মানছেন না। তিনি একের পর এক অপকর্ম করে চলেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর হামলা চালানো হয়।”এই নেতা আরও বলেন, “রাকিব মোল্লার কর্মকাণ্ডে সাধারণ নেতাকর্মীরা আতঙ্কে থাকেন। এমন চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দলের ভোটের রাজনীতিতে।”নেতাকর্মীরা দাবি জানিয়েছেন, দলের স্বার্থে অবিলম্বে রাকিব মোল্লার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকারের নিকট উক্ত বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন আপনার জানেন বিএনপি একটি সর্ববৃহৎ দল এই দলে কোন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস ও দখলবাজীর জায়গা হবে না। আপনারা নিশ্চয় জানেন উল্লেখিত অভিযোগের সাথে যারা জড়িত ছিলো দল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে । যদি গাজীপুর মহানগরের কোন নেতা উল্লেখিত কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা হাই-কমান্ডে সুপারিশ করবো তাদের ঠাই গাজীপুর মহানগর বিএনপিতে হবে না। উক্ত অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পূবাইল থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন মোল্লা মোবাইল ফোনে জানান, “আমি গাড়ি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা আমার এলাকায় এসে সরেজমিনে তদন্ত করুন। আমি একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী, আমাদের নিজেদের একটি পত্রিকাও রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।” তবে পরবর্তীতে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন এবং পরে কথা বলবেন বলে জানান।



Discussion about this post