
আল আমিন, নাটোর প্রতিনিধি :- নাটোরের লালপুর উপজেলার পদ্মা নদী ঘেঁষা রামকৃষ্ণপুর একটি প্রত্যন্ত এলাকা। এই গ্রামেই নীরবে নিভৃতে ৩২৮ বছর আগে গড়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের সৎসঙ্গ সেবাশ্রম। ৩২৮ বছরের পুরোনো এই আশ্রমকে ঘিরে নানা ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে স্থানীয় হিন্দু ধর্মালম্বীদের মাঝে। মনোরম, শান্ত, নিভৃত পরিবেশে ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের সমাধি মঠ সহ নানা নান্দনিক স্থাপনা মন কাড়ে দর্শনার্থীদের। ধর্মীয় বিশ্বাস ও নানা কাহিনীতে আশ্রমটি এলাকাখ্যাত। আশ্রমের প্রায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমান কয়েক কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের ১৬ নভেম্বর এই আশ্রম পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার ও প্রধান সেবাইত শ্রী চিমন্ত @পরমানন্দ সাধুর বিরুদ্ধে আদালতে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা দায়ের করেছেন বর্তমান কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার মন্ডল। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে মামলার তদন্তভার দিয়েছেন। এদিকে আশ্রমের পরিচালনা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ নিরসনে দ্রুক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছে লালপুর উপজেলা প্রশাসন। অভিযুক্ত সঞ্জয় কর্মকার পূজা উদযাপন পরিষদ লালপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। মামলা এবং আশ্রম পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, আশ্রমের নামে প্রায় ৬৫ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। যার মধ্যে আবাদি জমি প্রায় ৩০ বিঘা এবং চারটি পুকুর (আনুমানিক ২৫ বিঘা) ও ৮বিঘার আম বাগান রয়েছে যা লীজ দেওয়া রয়েছে। বর্তমান কমিটির অভিযোগ, গত ১২ বছরে আশ্রমের প্রায় ২৫ বিঘা পুকুর প্রায় ১ কোটি টাকা এবং প্রায় ৩০ বিঘা আবাদি জমি প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা ও আম বাগান ১০ লক্ষ টাকায় লীজ প্রদান করেন আশ্রম পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার ও প্রধান সেবাইত চিমন্ত চন্দ্র রায়@পরমানন্দ সাধু। সঞ্জয় কর্মকার সভাপতির পদে থাকাকালীন আশ্রমের কোন সংস্কার এবং উন্নয়ন না করে বিভিন্ন সময় আশ্রমের আয়কৃত প্রায় দেড় কোটি টাকার আতœসাৎ করেন। তারা আশ্রমের আয়কৃত অর্থ আশ্রমের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা করেননি। এমনকি কোন অডিট করানো হয়নি। এছাড়া, দান বাক্স লুট, গাছ কর্তন ও বিক্রির সমস্ত অর্থই সঞ্জয় ও তার সহযোগীরা মিলে আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগে আরো বলা হয়, কর্তৃত্ব বজায় রাখতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কমিটির মেয়াদপূর্তির নির্ধারিত সময়ের ৭ মাস পূর্বেই আরেকটি কমিটি গঠন করেন সঞ্জয় কর্মকার ও তার সহযোগীরা। বর্তমান আশ্রম পরিচালনা কমিটি হিসাব নিকাশ চাইলে তা নানা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন সঞ্জয় কর্মকার। অজ্ঞাত কারণে সাবেক সভাপতি সঞ্জয়কে একতরফা সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। সর্বশেষ ১৬ নভেম্বর আশ্রম পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার ও প্রধান সেবাইত শ্রী চিমন্ত চন্দ্র রায়@পরমানন্দ সাধুর বিরুদ্ধে আদালতে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা দায়ের করেন বর্তমান কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার মন্ডল। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে মামলার তদন্তভার দিয়েছেন। আগামী ১৯ জানুয়ারি আদালত লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, আশ্রম পরিচালনা বিষয়ে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন, গণমাধ্যমকর্মী এবং স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলস্বীদের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সঞ্জয় কর্মকার আশ্রমের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব-নিকাশ দিতে না পারায় তাকে আশ্রমের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি সর্বসম্মতিক্রমে উত্তম কুমার মন্ডলকে সভাপতি করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ আশ্রম পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, নতুন কমিটি গঠিত হলেও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এবং প্রধান সেবাইতের সহযোগীতায় অদ্যবধি সঞ্জয় কর্মকার আশ্রমের নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। সঞ্জয় কর্মকার তার নানা অনিয়ম ঢাকতে ঢাল হিসেবে আশ্রমের প্রধান সেবাইত শ্রী চিমন্ত রায় সাধুকে ব্যবহার করে আসছেন। আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সান্নিধ্যে তিনি একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। আশ্রমের সেবাইতের ভরণ-পোষণ, বিদ্যুৎ বিল, বার্ষিক নবান্ন অনুষ্ঠান ছাড়া আশ্রমের উল্লেখ্যযোগ্য কোন ব্যয় নেই। এরপরেও আশ্রমের নানা খরচের কথা উল্লেখ করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সঞ্জয় কর্মকার বর্তমানে লালপুর উপজেলার বিলমাড়ীয়া বাজারে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জায়গা কিনে বাড়ী নির্মাণ করে বসবাস করছেন। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ১৯৮৮ সালের মামলার (মা: নং: ১১৯/৮৮) আদেশে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত বিবাদীগণ যার মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সহ অন্যান্য ব্যক্তিগণ পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে গঠিত পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন। এবং এই কমিটি ২০০৭ সাল পর্যন্ত আশ্রম পরিচালনা করে। বর্তমান কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার মন্ডল ১৯৮৮ ও ২০১২ সালের দুটি মামলার একতরফা রায়ের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে জবাব দাখিল করেছেন। এছাড়া ১৯/২৫ অঃপ্রঃ মামলার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বর্তমান কমিটির আপীল (মাঃ নং ২৭/২০২৫) গ্রহণ করেছেন মাননীয় আদালত। আশ্রমের বর্তমান পরিচালনা কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার মন্ডল জানান, সাবেক সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার ও প্রধান সেবাইত শ্রী চিমন্ত চন্দ্র রায় @পরমানন্দ সাধু যোগসাজেশ করে আশ্রমের প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তারা আশ্রমের সংস্কার ও উন্নয়ন করেননি। এমনকি কোন অডিট করানো হয়নি। লুটপাটকৃত সমুদয় অর্থ পুনরুদ্ধার করতে সঞ্জয় ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে দেড় কোটি টাকা আতœসাতের মামলা দায়ের করেছি। আমি আশ্রমের অর্থ আতœসাৎকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি। তিনি আরো জানান, আদৌতে প্রধান সেবাইত একজন অযোগ্য, ভন্ড, প্রতারক শ্রেণীর লোক। তার সেবাইতের সনদপত্র ও শিক্ষাগত কোন সনদপত্র নেই। তথাপি তিনি বহাল তবিয়তে নানা অনিয়ম করে চলেছেন। তদন্ত করে দেখলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, পূর্বের স্থানীয় প্রশাসন একতরফাভাবে বিতর্কিত সাবেক কমিটিকে নানা সুবিধা দিয়ে এসেছে। আমি সহ আমার কমিটির অনেকের বিরুদ্ধে সঞ্জয় কর্মকার ষড়যন্ত্রমূলক একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করে আসছে। নতুন কমিটি হলেও সঞ্জয় কর্মকার আশ্রমের প্রধান সেবাইতের সহযোগীতায় নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। এখনও এর কোন সুরাহা হয় নাই। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন ফ্রন্ট নাটোর জেলা শাখার সদস্য সচিব নির্মল কুমার সরকার জানান, সাবেক কমিটির সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার একজন মামলাবাজ লোক। তিনি আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে এলাকার অনেক পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এমনকি বিমল নামে সঞ্জয়ের কাছের একজন ব্যক্তি আশ্রমে থাকেন যার বিরুদ্ধে বাঘা থানায় মাদকের একটি মামলা রয়েছে এবং তিনি এখনও মাদক ব্যবসা করেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট নাটোর জেলার সদস্য সচিব সঞ্জীব গুহ জানান, সঞ্জয় কর্মকার বিভিন্ন সময় নানা দূর্নীতি ও অনিয়ম করেছে। তিনি আশ্রমের কোন উন্নয়ন করেনি। অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সঞ্জয় কর্মকার নতুন কমিটির বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করছে। ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের প্রধান সেবাইত শ্রী চিমন্ত চন্দ্র রায় @পরমানন্দ সাধু জানান, অনিয়মের বিষয়টি সঠিক নয়। আমরা সাবেক কমিটি দিয়ে আশ্রম ভালভাবেই পরিচালনা করছি। লীজ প্রদানকৃত অর্থ দ্বারা আশ্রমের ২০০৭ সালের আগের কমিটির করে যাওয়া ঋণ-কর্জ পরিশোধের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ধার-দেনা পরিশোধের পর ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দেওয়ার মত অর্থ থাকে না। যার কারণে আশ্রমের ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা জমা দেওয়া হয়নি। তবে, আশ্রমের সার্বিক আয়-ব্যয়, লীজ প্রদানকৃত অর্থের সমদুয় টাকার হিসাব চাইলে তিনি জবাব না দিয়ে পলায়ন করেন। আশ্রম পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সঞ্জয় কর্মকার জানান, টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ভিত্তিহীন, বানোয়াট। এ বিষয়ে মামলা চলমান আছে। এছাড়া আশ্রমের অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুুলহাস হোসেন সৌরভ জানান, আশ্রম কেন্দ্রীক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে দুই পক্ষকেই অনুরোধ করা হয়েছে। সাবেক কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে দেড়কোটি টাকা আত্মসাতের মামলার বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে কমিটি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে দ্রæত দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করে স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম জানান, দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের মামলার বিষয়টি আমি অবগত। এ বিষয়ে তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। এছাড়া সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Discussion about this post