
বশিরুল আলম, আলমডাঙ্গা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চুয়াডাঙ্গা তথা আলমডাঙ্গার ভূমিকা এক উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল এই অঞ্চল। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ এলাকার মানুষ বিজয়ের স্বাদ পায়—যা আজও একই আবেগে স্মরণ করা হয়।২৫ মার্চের গণহত্যার খবর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পরপরই চুয়াডাঙ্গা মহকুমায় শুরু হয় তীব্র প্রতিরোধ। শহরের প্রতিটি প্রবেশপথে গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা চুয়াডাঙ্গা ইপিআর সদর দফতরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কমান্ড। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০৪ সদস্যের সমন্বয়ে এই কমান্ড মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠিত বাহিনী হিসেবে কাজ শুরু করে। শ্রীমন্ত টাউন হলে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সমবেত করে ট্রেজারি থেকে অস্ত্র–গোলাবারুদ বিতরণ করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডা. আসহাবুল হক হ্যাবা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি তখন যুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব দিতে থাকে। ৩০ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ চুয়াডাঙ্গায় এসে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে এ অঞ্চল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। দেশের প্রতিটি ব্যাংকের সম্পদ অস্থায়ী সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হওয়ায় পুরো চুয়াডাঙ্গা এক বিপ্লবী জনপদে পরিণত হয়। এই খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পৌঁছে গেলে পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় পুরো অঞ্চলটি। ৩ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রচণ্ড বিমান হামলা শুরু করে। নিরাপত্তাজনিত কারণে অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান এখানে অনুষ্ঠিত না হলেও চুয়াডাঙ্গাই ছিল প্রথম পরিকল্পিত স্থান।১৬ এপ্রিল যশোর সেনানিবাস থেকে আগত পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা দখল করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। এরপর সদর দপ্তর সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় মুক্তিবাহিনী। ১১ জুলাই দেশ ১১ সেক্টরে বিভক্ত হলে চুয়াডাঙ্গা যুক্ত হয় ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি গেরিলা অভিযানও চলে সমানতালে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকার কারণে অঞ্চলটি বারবার পাকবাহিনীর চাপে থাকলেও ভেঙে পড়েননি বীরযোদ্ধারা। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী দর্শনা দখল করে। দর্শনার পাকবাহিনী তখন চুয়াডাঙ্গা শহরে পালিয়ে আসে। ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুরের পাকসেনারা ২৮ কিলোমিটার হেঁটে এসে চুয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেয়।উত্তরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিশাল ট্যাংক বহর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রার মুখে ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে পালিয়ে যায়।মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গা মুক্ত হওয়ার পরপরই খবর আসে—পাকিস্তানি সেনারা আলমডাঙ্গা হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে পালাচ্ছে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন সাব–সেক্টর কমান্ডার তৌফিক ইলাহি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় যোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান, মুজিব বাহিনী কমান্ডার কাজী কামালসহ ছোট ছোট দল সমন্বয় করে আলমডাঙ্গায় আক্রমণাত্মক অবস্থান নেন।৭ ডিসেম্বর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর পাল্টা হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হন।পাকিস্তানি বাহিনী শেষে সুতাইল–আম্বাড়িয়া–হালসা হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। বিজয়ের পতাকা উড়ে যায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। তারপর থেকেই এ দিনটি আলমডাঙ্গা বাসী শ্রদ্ধা–সম্মান ও গর্বের সঙ্গে ‘আলমডাঙ্গা মুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। ৮ ডিসেম্বর কেবল একটি তারিখ নয়—এটি একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিজয়ের প্রতীক। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের অনন্য দলিল এ দিনের ইতিহাস। আজ আলমডাঙ্গা মুক্ত দিবসে শোক-সম্মান- গৌরবের মিশেলে স্মরণ করা হয় সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোকে।



Discussion about this post