
শেখ মামুনুর রশীদ মামুনঃ-ময়মনসিংহবাসীর স্বপ্নের কেওয়াটখালী স্টিল আর্চ ব্রিজ এখন চরম বিতর্কের কেন্দ্রে। একনেক অনুমোদিত নকশা উপেক্ষা করে, ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রকল্পে—এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছে নাগরিক সংগঠন ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন। ভূমি অধিগ্রহণে অস্বচ্ছতা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বৃদ্ধি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ দাবি করে প্রকল্পে হস্তক্ষেপ ও বিচার চেয়ে হাইকোর্টে রীট করা হয়েছে। শনিবার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে সংগঠনটি। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ। উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক, পরিবেশবাদী নেতা, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীরা। নকশা বদল আর্থিক কেলেঙ্কারির ফাঁদে পরিণত হয়েছেঃ আজাদের ভাষায়, “সরকার অনুমোদিত নকশায় যেখানে সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৫.১ কিলোমিটার, সেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা বাড়িয়ে ৮.২ কিলোমিটার করা হয়েছে—যা প্রকল্প অনুমোদনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।” এর ফলে প্রকল্প ব্যয় কমপক্ষে ২,০০০ কোটি টাকা বাড়বে বলে দাবি তার। মূল প্রকল্প ব্যয় ছিল ৩,২৬৩ কোটি টাকা। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ৮১.৫৬ একর থেকে অকারণে বাড়িয়ে ১১৩ একর করা হয়েছে, যার কারণে ৫০০ কোটিরও বেশি অতিরিক্ত ব্যয় চাপবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
আজাদ বলেন, “এই অতিরিক্ত জমির মালিকদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, ফলে পুরো প্রকল্পটি এখন প্রভাবশালীদের লুটপাটের মাঠে পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যয় নয়, বিপন্ন হচ্ছে জনজীবন ও নকশা বহির্ভূত সংযোগ সড়কের ফলে কৃষিজমি, মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ ও শতাধিক ঘরবাড়ি উচ্ছেদের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে বন্ধ হতে পারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও যানজট। ময়মনসিংহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র ফয়সাল ফারনিম বলেন, “ময়মনসিংহ এমনিতেই বিশ্বের নবম ধীরগতির শহর। পরিবর্তিত নকশায় এই সংযোগ সড়ক বাস্তবায়ন হলে শহরটি শিগগিরই বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধীরগতির শহরের তালিকায় ঠাঁই পাবে। ”পুরাতন চায়না সড়কে সংযোগ: পরিকল্পনা নাকি ষড়যন্ত্র? -সংগঠনের সদস্য বিপ্লব নিভ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “সংযোগ সড়কটি যুক্ত করা হচ্ছে পুরাতন চায়না হাইওয়ের সঙ্গে, যা শহরের যানজট আরও বাড়াবে এবং ভবিষ্যতে এটি মরণফাঁদে পরিণত হতে পারে।
হাইকোর্টে রীট: ন্যায়বিচার চায় জনগণঃ-সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ৪ জুন হাইকোর্টে আবুল কালাম আল আজাদ বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য শিরোনামে একটি জনস্বার্থ রীট মামলা দায়ের করা হয়। আদালত একনেক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে রুল জারি করেছেন। এদিকে সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এতে করে আরও প্রশ্ন উঠছে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও এর স্বচ্ছতা নিয়ে। ছয় দফা দাবিতে একাট্টা নাগরিক সমাজঃ-সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন’ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে— ১. একনেক অনুমোদিত মূল নকশা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন ২. অনুমোদিত নকশা জনসম্মুখে প্রদর্শনের ব্যবস্থা ৩. নকশা পরিবর্তনের পেছনের চক্র প্রকাশ ৪. জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ৫. জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ৬. তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংযোগ সড়ক ও ভূমি অধিগ্রহণ স্থগিত। সংগঠনের আহ্বানঃ—“আমরা স্টিল আর্চ ব্রিজের বিরুদ্ধে নই, তবে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির নামে জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আমরা একজোট।-এই প্রতিবেদন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা, জনঅংশগ্রহণ ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। ‘উন্নয়নের নামে অন্ধকার নয়, চাই আলো, জবাবদিহিতা ও জনগণের অধিকার’—এটাই এখন সময়ের দাবি।



Discussion about this post