
বশিরুল আলম, আলমডাঙ্গা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌরসভার আনন্দধাম কালীতলা ক্যানেলপাড়ার একটি বেকারিতে রবিবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে ঘটে গেলো হৃদয়বিদারক এক দুর্ঘটনা। উৎপাদনশীল কাজের স্বপ্ন নিয়ে কর্মক্ষেত্রে পা রাখা ১৬ বছর বয়সী কিশোর শ্রমিক সোহান আলী প্রাণ হারালেন একটি মিক্সার মেশিনের ভেতর। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘ভাই-বোন বেকারি’—যেখানে প্রতিদিন শত শত রুটি, কেক, বিস্কুট তৈরি হয়ে বাজারে বিতরণ হয়—সেই বেকারিরই মিক্সার মেশিনে হাত আটকে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সোহানের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার মুহূর্তটি ছিল এতটাই দ্রুত ও ভয়াবহ যে অন্য শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে পড়েন কিশোরটি। সোহান আলী স্থানীয় এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে। সংসারের হাল ধরতে, মায়ের হাসিটুকু ফিরে পেতে, নিজের ছোট ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ মেটাতে বয়সের তুলনায় অনেক কঠিন দায়িত্ব নিয়েছিল সে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করলেও ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো ছিল খুব সাধারণ—শুধু একটু ভালো থাকা। কিন্তু একটি অসতর্ক মুহূর্ত, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আর ঘনঘন অবহেলার সংস্কৃতি সেই ছোট্ট স্বপ্নটুকুও ছিনিয়ে নিলো। ঘটনার পর স্থানীয় শ্রমিক ও এলাকাবাসীর অভিযোগ অধিকাংশ বেকারি শ্রমিকই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেশিন পরিচালনায় নেই কোনো প্রশিক্ষণ নেই হেলমেট, গ্লাভস, সেফটি গার্ড কিংবা জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরনো মিক্সার মেশিন দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে তারা বলেন, “শুধু সোহান নয়, এই এলাকায় অনেক কিশোরই বিদ্যালয় ফেলে বেকারি, ওয়ার্কশপ, গার্মেন্টস ও ছোট শিল্পকারখানায় কাজ করছে। কোথাও নিরাপত্তার মানদণ্ড নেই।”কর্মক্ষেত্রে কিশোর শ্রমিক নিয়োগ করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে এ নিয়ম প্রায় অবহেলিত। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই কর্মঘণ্টা, সেলফ-সেফটি কিংবা প্রশিক্ষণের কোনো নিয়ম অনুসরণ করে না। মৃত্যু বা দুর্ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন তৎপরতা দেখা গেলেও সময়ের সাথে সবকিছু আবার আগের মতোই হয়ে যায়। স্থানীয়রা বলেন— “একজন কিশোর মারা গেলে এর বিচার হয় না, তদন্ত হয় না, মালিকদের জবাবদিহি হয় না। তাই বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।”ড়সোহানের মা সন্তানের মৃত্যুর পর বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অসীম যন্ত্রণায় তিনি শুধু বলছিলেন—“আমার ছেলেটা এত কষ্ট করত। ভাবতাম একদিন সংসারটা দাঁড় করাবে। মেশিনই আমার ছেলেকে গিলে খেলো।”তার এ কান্না কেবল একটি পরিবারের শোক নয়—এটি সমাজের বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক বেদনাময় আর্তনাদ।সোহানের মৃত্যু নতুন কিছু নয়—বরং দেশের অগণিত কিশোর শ্রমিকের প্রতিদিনের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্নগুলো স্পষ্ট কেন আইন থাকা সত্ত্বেও কিশোর শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হচ্ছে না? কেন শিল্পকারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে না? একটি প্রাণহানির পরও কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু আনুষ্ঠানিকতা সারবে? আলমডাঙ্গার ভাই-বোন বেকারিতে সোহান আলীর মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি আমাদের সমাজ, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতি একটি বড় প্রশ্ন। কিশোর শ্রমিকদের জীবন কি এতোই সস্তা? আজ সোহান নেই। কিন্তু তার মৃত্যু আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে—কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে আর কত সোহান অকালেই ঝরে পড়বে?



Discussion about this post