
বশিরুল আলম,আলমডাঙ্গা (চুয়াডাঙ্গা) প্রতিনিধি:- ভোরের আলো ফোটার আগেই আলমডাঙ্গার একটি বাড়িতে শুরু হয় কান্না। এক সময়ের মেধাবী, হাসিখুশি কলেজপড়ুয়া ছেলেটি আজ ঘরের এক কোণে নিথর হয়ে পড়ে আছে। চোখে শূন্যতা, মুখে ক্লান্তির ছাপ। মা জানেন, তার ছেলেকে গ্রাস করেছে মাদক। সংসারের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বারবার চেষ্টা করেছেন তাকে বাঁচাতে, কিন্তু সমাজ আর ব্যবস্থার নিষ্ঠুর উদাসীনতায় সেই চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এই গল্প শুধু একটি পরিবারের নয়—এ গল্প আজ আলমডাঙ্গার অসংখ্য পরিবারের নীরব আর্তনাদ। এক সময়ের সম্ভাবনাময় জনপদ আলমডাঙ্গা আজ নীরবে পরিণত হচ্ছে মাদকের ভয়ংকর অভয়ারণ্যে। মরণনেশার ছোবলে প্রতিদিন দিকভ্রান্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। স্কুল–কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কর্মক্ষম যুবক—কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই সর্বনাশা আসক্তি থেকে। ভেঙে পড়ছে পরিবার, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ; অথচ কার্যকর প্রতিরোধে যেন নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ।মাকড়সার জালের মতো সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চোখে পড়লেও সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানো বলেই মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। অভিযোগ রয়েছে, ছোটখাটো মাদকাসক্ত বা খুচরা বিক্রেতা আটক হলেও মূল কারবারিরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অধিকাংশ মাদক মামলাই সাক্ষীর অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার যেসব ঘটনায় সাক্ষী পাওয়া যায়, তারা নিরাপত্তাহীনতা, হুমকি ও প্রভাবশালী মহলের চাপে মুখ খুলতে সাহস পান না। ফলে গ্রেপ্তার হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আসে মাদক কারবারিরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি মহলের ছত্রচ্ছায়া, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রহস্যজনক নীরবতা এবং নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় অনীহা। এসব কারণে বারবার অভিযোগ উঠলেও টেকসই ও কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। কোনো কোনো এলাকায় প্রকাশ্যেই চলছে মাদক বিক্রি ও সেবন—যা প্রশাসনিক নজরদারির বড় ঘাটতির দিকেই ইঙ্গিত করে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আলমডাঙ্গার স্টেশন মোড় ও পুরাতন বাসস্ট্যান্ড বর্তমানে মাদক বিক্রির অন্যতম প্রধান হটস্পট হিসেবে পরিচিত। এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে মরণনেশা উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে। এছাড়াও নিয়মিত মাদক কেনাবেচা ও সেবনের অভিযোগ রয়েছে—উপজেলা নতুন ভবন এলাকা, পৌরসভার সামনে স্টেডিয়ামের ওপর, থানাপাড়া পুকুরপাড়, রেলস্টেশনের ওপর ও ঢালে, লালব্রিজ সংলগ্ন কালভার্টের ওপর এবং ফকট এলাকায়। দিনের আলো কিংবা গভীর রাত—সময় যেন কোনো বাধা নয় মাদক কারবারিদের জন্য। এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হাজী সাহেব। তিনি বলেন,“মাদক আজ আলমডাঙ্গার জন্য শুধু আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক ও সামাজিক বিপর্যয়। তরুণ সমাজ ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। এখনই যদি শক্ত হাতে প্রতিরোধ গড়ে না তোলা হয় এবং মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ পরিণতি আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হবে।”তিনি আরও বলেন, “স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক বা যে কোন মহলের প্রভাবমুক্ত অভিযান, নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং কার্যকর পুনর্বাসন কার্যক্রম ছাড়া মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। এখনই উদ্যোগ না নিলে আলমডাঙ্গার তরুণ সমাজ একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মে পরিণত হবে।” আজ আলমডাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে এক কঠিন সন্ধিক্ষণে। সময় এসেছে দায় এড়ানোর নয়, সময় এসেছে দায়িত্ব নেওয়ার। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠন ও সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগেই কেবল এই মরণনেশার বিরুদ্ধে গড়ে তোলা সম্ভব প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল। নচেৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়। সময় এসেছে—নতুন বাংলাদেশ গড়ার।



Discussion about this post